১০ ই মহররম পবিত্র আশুরা, আশুরার দিনে কি হয়েছিল, আশুরার প্রকৃত ঘটনার, এই দিনে যা যা করণীয় এবং বর্জনীয়, বিস্তারিত বিবরণ.

আশুরার দিনে কি হয়েছিল, আশুরার প্রকৃত ঘটনার বিবরণ।

মহররম মাস হচ্ছে চান্দ্রবছরের প্রথম মাস, বছরের অতি সম্মানিত চার মাসের একটি হচ্ছে এই মাস। মুসলমানদের মহররম অত্যন্ত ফজিলতময় মাস। এ মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। 

মহররমের দশ তারিখ নিয়ে সঠিক অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলা হলেও বিশুদ্ধ বর্ণনায় মাত্র দু’টি ঘটনার কথা জানা যায়।

০১. ফেরাউন ও তার সৈন্যদের কবল থেকে মূসা (আ.) এর মুক্তি পাওয়ার ঘটনা

হজরত মূসা আলাইহিস সাল্লাম এবং তার সাথীদের ফেরাউন ও তার সৈন্যদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘটনা। যেখানে দরিয়ায় রাস্তা বানিয়ে আল্লাহতায়ালা তাদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছেন।

ইতিহাসে পাওয়া যায়, আশুরার দশ তারিখে অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের হাত থেকে আল্লাহতায়ালা বনী ইসরাঈলকে রক্ষা করেন। এবং হজরত মুসা হজরত মূসা আলাইহিস সাল্লাম কে ফেরাউনের ওপর বিজয় দান করেন। এ জন্য দিনটিকে মুসলিম মিল্লাতের বিজয়ের দিন বলা হয়।

০২. ফেরাউন ও তার সৈন্যদের দরিয়ায় ডুবিয়ে ধ্বংস করা.

হজরত মূসা আলাইহিস সালাম এবং তার সাথীদের কে ফেরাউন ও তার সৈন্যদল আক্রমণ করলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ফেরাউন ও তার সৈন্যদের দরিয়ায় ডুবিয়ে ধ্বংস করার ঘটনা।

এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আর বনী ইসরাঈলকে আমি পার করে দিয়েছি নদী। তারপর তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেছে ফেরাউন ও সেনাবাহিনী, দুরাচার ও বাড়াবাড়ির উদ্দেশ্যে। এমনকি যখন তারা ডুবতে আরম্ভ করল, তখন বলল, এবার বিশ্বাস করে নিচ্ছি যে, কোনো মাবুদ নেই তাকে ছাড়া যার ওপর ঈমান এনেছে বনী ইসরাঈলরা। বস্তুত আমি তারই অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। এখন একথা বলছ। অথচ তুমি ইতোপূর্বে নাফরমানি করেছিলে এবং পথভ্রষ্টদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলে। অতএব আজকের দিনে বাঁচিয়ে দিচ্ছি আমি তোমার দেহকে যাতে তোমার পশ্চাদবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারে। আর নিঃসন্দেহে বহু লোক আমার মহাশক্তির প্রতি লক্ষ্য করে না।’ -সূরা ইউনুস: ৯০-৯২

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার দয়ায় হজরত মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরাউনের উপর বিজয় অর্জন করেন এবং এই বিজয়ের শুকরিয়াস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) ও তার অনুসারীরা আশুরার দিনে রোজা রাখতেন। 

এই নিয়ে যে হাদিস টির ব্যাখ্যা নিচে উল্লেখ করা হলো.

হজরত আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) যখন মদিনায় আগমন করলেন, দেখলেন এদিনে ইহুদিরা রোজা রাখে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন দিন যে তোমরা রোজা রাখছ? তখন উত্তরে তারা বলল, এই দিনে আল্লাহ হজরত মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায়কে অত্যাচারি ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম

অনেক কিতাবে লেখা আছে, আশুরার দিনে কিয়ামত সংগঠিত হবে। কিন্তু এ কথার কোনো ভিত্তি নেই, কোনো কোনো রেওয়ায়েতে বলা হয়, আশুরার দিনে হজরত আদম আলাইহিস সালামের তওবা কবুল হয়েছে। এমনকি একথা আবুল কাসেম ইস্পাহানি (রহ.) কর্তৃক সংকলিত আত তারগিব ওয়াত তারহিবের ১৮৬৮ নম্বর রেওয়ায়েতে এসেছে। কিন্তু এই রেওয়ায়েতের সনদ খুবই দুর্বল। এ ছাড়া আরও কিছু রেওয়ায়েতে এই কথা এসেছে, সেগুলো মওযু তথা দুর্বল।

যেদিন হজরত নূহ আলাইহিস সালামের কিশতি জুদি পাহাড়ে থেমেছিল সেই দিনটি ছিল আশুরার দিন, এই রেওয়ায়েতও দুর্বল। তবে এটা ঠিক যে, একথা মুসনাদে আহমাদের একটি রেওয়ায়েতে এসেছে, কিন্তু তার সনদ দুর্বল।

আরেকটি বিষয়। আমাদের দেশের সংবাদপত্র থেকে শুরু করে আশুরাকেন্দ্রিক যাবতীয় আলোচনায় শুধু কারবালার ঘটনা উল্লেখ করা হয়। মনে হয়, আশুরায় শুধু কারবালার ঘটনাই ঘটেছে। আশুরা তাৎপর্যময় হয়েছে কারবালার কারণে। বিষয়টি কিন্তু তা নয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের প্রায় ৫০ বছর পর ৬১ হিজরির ১০ মহররমে কারবালায় হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা আশুরার দিনের সঙ্গে মিলে যাওয়া একটি ঘটনাবিশেষ মাত্র কিন্তু এই ঘটনা আশুরার আমলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এটা একেবারে ই ভিন্ন।

কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের আগেই আমাদের শরিয়ত পূর্ণ হয়ে গেছে। কিয়ামত পর্যন্ত এই শরিয়ত পূর্ণাঙ্গরূপে সংরক্ষিত থাকবে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইন্তেকালের পরে সংঘটিত কোনো বিপদ বা আনন্দের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শরিয়তে কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ নেই, উম্মতের ওপর ওয়াজিব হলো সেই হুকুম অনুযায়ী আমল করা.

কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত বলো না। প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা (তাদের জীবিত থাকার বিষয়টা) উপলব্ধি করতে পারো না। আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব (কখনও) কিছুটা ভয়-ভীতি দ্বারা, (কখনও) জানমাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা। সুসংবাদ শোনাও তাদেরকে, যারা (এরূপ অবস্থায়) সবরের পরিচয় দেয়। যারা কোনো মসিবত দেখা দিলে বলে ওঠে, আমরা সকলে আল্লাহরই এবং আমাদেরকে তার কাছেই ফিরে যেতে হবে। এরাই তারা, যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে বিশেষ করুণা ও দয়া রয়েছে এবং এরাই আছে হেদায়েতের ওপর। -সূরা বাকারা: ১৫৪-১৫৭

কারবালায় হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের ঘটনা আমাদের জন্য বিপদ ও মসিবতের বিসয়। এক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়তের হুকুম হলো সবর করা অর্থাৎ ধৈর্যধারণ করা। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়বে এবং আল্লাহতায়ালার কাছে সওয়াবের আশা করবে।

কারও ইন্তেকালে শরিয়তের হুকুম হলো সবর করা অর্থাৎ ধৈর্যধারণ করা। অধৈর্য হয়ে অভিযোগপূর্ণ কোনো কথা বলা, বিলাপ করা, হাত পা ও বুক চাপড়ানো, চেহারা খামচানো, শোকের পোশাক পরা ইত্যাদি হারাম, হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি মুখে আঘাত করে, জামার বুক ছিঁড়ে, জাহিলি যুগের (মতো) বিলাপ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। সহিহ বুখারি ১/১৭২

এই বেপারে অন্য আরো একটি হাদিস রয়েছে যেখানে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি ওই ব্যক্তি থেকে মুক্ত, যে শোকে মাথা মুণ্ডায়, বুক চাপড়ায় ও কাপড় ছিঁড়ে। সহিহ মুসলিম: ১৬৭.

কারবালার প্রান্তরে হজরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের পর তিন শ’ বছর পর্যন্ত ১০ মহররমে কান্নাকাটি, আহাজারি, নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করা, চিৎকার ও বুক চাপড়ানো প্রথার কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। 

হাজরাত হোসাইন (রা.) শহীদ হওয়ার ৩০০ বসার পর ৩৫২ হিজরিতে সর্বপ্রথম মুঈযযুদ দাওলা দাইলামি দশ মহররমে বাগদাদে হজরত হুসাইন (রা.) এর জন্য মাতম করার হুকুম জারি করে। 

তার ১১ বছর পর ৩৬৩ হিজরিতে মিসরে একই হুকুম জারি করা হয়, আর সেই থেকে এই প্রথা চলে আসছে কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মাঝে, তবে আমাদের বুজা উচিত আল্লাহ কোথাও বলেনি তোমার শোকে বিবর হয়ে নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করো, আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দেন করুন আমীন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন